বড় ভাই আযহার মাহমুদ ঢাকাতে একদিন বলেছিল, ‘তোমাদের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জে বাস থেকে নামলেই সুন্দরবন খুব কাছে থেকে দেখা যায়।
বাগেরহাটের মোংলা হয়ে সুন্দরবন তো সবাই যায়।’ সত্যিই এর আগে আমি নিজেও দু’বার মোংলা দিয়েই সুন্দরবন গিয়েছি।
সাতক্ষীরা দিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ নিঃসন্দেহে নতুন এক মাত্রা যোগ করবে।
সাতক্ষীরা দিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত হলো। সবাই মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে এসে একত্রিত হব।
শ্যামনগরের নওয়াবেকিতে আছেন আমার পরিচিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু নাইম ভাই।
আযহার মাহমুদ ভাই রাতেই ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছেন, নাইম ভাইয়ের বাসায় রেস্ট নিয়ে দুপুরে মুন্সিগঞ্জ যাবেন।
আমি সাতক্ষীরা শহর থেকে সকাল ১০টায় রওনা দিলাম।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছোট ভাই আজাহার ইসলামও শ্যামনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।
দুপুরের পরেই আযহার ভাই, নাইম ভাই ও আমি মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে একত্রিত হলাম।
আমরা একেবারে সুন্দরবনের ভিতরে বরসা রিসোর্টে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। রুমে ব্যাগ রেখে ফ্রেস হয়ে আশপাশে কি আছে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেরিয়ে গেলাম।
পাশেই দেখা মিলল আকাশনীলা ইকো ট্যুরিজম সেন্টারের, টিকিট নিয়ে কাঠের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললে যতদূর চোখ যায়, শুধুই সবুজের সীমানা।
শরীরে এসে ছুঁয়ে যায় বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা জলভেজা শীতল হাওয়া।
এখানেই পরিচয় হল ফটোগ্রাফার মামুনের সঙ্গে। সে তার ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ব্লগ বানাতে এসেছে।
ওর সঙ্গে কথা হলো কাল ও আমাদের সফরসঙ্গী হবে। নৌকাতে করে সুন্দরবনে বেড়ানো অন্যরকম এক আনন্দের, কাল আমরা নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাচ্ছি।
রাত ৮টার দিকে আজাহার ইসলাম মুন্সিগঞ্জ এসে পৌঁছাল। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেলাম।
পরদিন সকালে মুস্তাফিজুর রহমান ও মামুন বরসা রিসোর্টে চলে এলো।
আমরা ৬ জনের একটি দল তৈরি সুন্দরবনে বেড়ানোর জন্য।
সকাল ১০টায় বরসা রিসোর্টের পাশে চুনা নদীর কোলঘেঁষা কলবাড়ি মোড়ে নাশতা সেরে নিলাম।
বলে রাখা ভালো, এই কলবাড়ি চুনা নদীর পাড়েই ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি বিকালে দুটি বাঘকে ঘোরাফেরা করতে দেখে স্থানীয় টাইগার টিমের সদস্যরা ও বন বিভাগ যৌথভাবে সন্ধ্যায় মাইকিং করে স্থানীয়দের সতর্ক করেছিল।
তারপরও পরদিন তিন জেলে কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনে প্রবেশ করলে বাঘের কবলে পড়ে ২ জন নিহত ১ জন আহত হন।
কিছু শুকনা খাবার নিয়ে আমরা ভ্যানগাড়িতে চড়ে বুড়িগোয়ালিনির নীলডুমুর খেয়াঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যেতে যেতে রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়ল অসংখ্য চিংড়ি আর কাঁকড়া ঘের।
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের কাঁকড়া ঘেরটি নীলডুমুর যেতে রাস্তার বামপাশেই পড়বে।
স্থানীয় ওসির মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জ বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি (পাস) নিয়ে ২ জন গার্ড সঙ্গে করে চলে গেলাম ইঞ্জিনচালিত নৌকার ঘাটে।
খোলপেটুয়া নদীতে নোঙর করা আমাদের জন্য নির্ধারিত নৌকাতেই উঠলাম। খোলপেটুয়া নদীর বুক চিরে এগিয়ে যেতে থাকল আমাদের নৌকা।
নদীর দু’পাশে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য, সবুজে আচ্ছন্ন গাছপালায় উড়ে বেড়াচ্ছে নানা জাতের পাখি।
ভাগ্য ভালো হলে চোখে পড়তে পারে নদীতে হঠাৎ ভেসে ওঠা কুমির ও শুশুক। নৌকা চলছে।
আবহাওয়া অনেক সুন্দর, ঝলমলে আকাশ। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে ঘন জঙ্গলে ঘেরা নদীর পাড়ে তাকিয়ে আছি হরিণের পাল ও বাঘ দেখার নেশায়।
ইতোমধ্যে আমাদের নৌকা কলাগাছি নদীতে চলে এলো। নদীটি আগের নদী থেকে বড়, দু’পাশেই সুন্দরবন।
দুই ধারের সারি সারি গোলপাতা, কেওড়া, গেওয়া, গরান, বাইন, কাঁকড়া, সুন্দরী বন সত্যিই মুগ্ধ করে।
আধা ঘণ্টাখানেক চলার পর নৌকা কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে প্রথম যাত্রা বিরতি করল।
নৌকা তীরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই লাফিয়ে তীরে নামলাম। নামতেই সবাইকে অভ্যর্থনা জানাল দুষ্টু বানরের দল।
ভিতরে ঢুকলেই আশপাশে ভিড়ে বানরের দল।
বন বিভাগের তৈরি করা কাঠের রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে সবাই বনের অনেক ভেতরে চলে এলাম এবং এখানেই হরিণের দেখা পেলাম।
বন্য হরিণকে চিপস, বানরকে মুড়ি খাওয়ালাম। ওদের খাওয়ানোর জন্য সঙ্গে বাদাম, চিপস, মুড়ি নিতে অবশ্যই ভুলবেন না।
গার্ড আমাদের কাদার ওপর বাঘের পায়ের ছাপ দেখিয়ে বলল, ‘বেশি সাহস দেখিয়ে বনের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না, তাতে বিপদ হতে পারে।
কাদায় নামার আগে খেয়াল রাখবেন পায়ের দিকে।
গাছের খাড়া শ্বাসমূল পায়ে ফুটতে পারে।’ গার্ডের মাধ্যমে সুন্দরবনের সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, কাঁকড়া, খলিসাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, ফার্ন চিনতে পারলাম।
দেখা পেলাম রংবেরঙের ছোট কাঁকড়া।
কলাগাছিয়াতে কিছু সময় কাটিয়ে আবার সবাই নৌকাতে উঠলাম। অপরূপ সৌন্দর্যের লিলাভূমি কলাগাছিয়া।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনি স্টেশনের অধীনে এই ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের অবস্থান।
পরবর্তী গন্তব্য দোবেকি। বিশাল নদীর পানিকে দুই পাশে ঠেলে এগিয়ে চলতে লাগল আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা।
মালঞ্চ নদীতে নৌকা প্রবেশ করলে ধুম বাতাসে ঘুমে চোখ বুজে আসতে লাগল।
আযহার মাহমুদ ভাইয়ের ডাকাডাকিতে তন্দ্রাভাব চলে গেলে বুঝলাম দেড় ঘণ্টা চলার পর আমরা দোবেকি ফরেস্ট রেঞ্জে পৌঁছেছি।
ভেতরে ঢুকতেই প্রথমেই চোখে পড়ল চারিদিকে নারিকেল গাছ ও বিভিন্ন বৃক্ষ বেষ্টিত একটি বড় মিঠা পানির পুকুর। পুকুর পাড়ে হরিণের দেখাও মিলল।
গার্ড জানাল, ‘নদীর পানি নোনা হওয়ায় গভীর রাতে বাঘ এ পুকুরের মিঠা পানি খেতে আসে।
এটাও জানাল রাতের বেলা ধৈর্য ধরে ওয়াচ টাওয়ারে অবস্থান করলে ভাগ্য সহায় হলে বাঘের দেখা পেয়েও যেতে পারেন।’
গার্ডকে বাঘ দেখেছেন কিনা প্রশ্ন করতে জানাল, ‘আসার সময় দোয়া পড়তে পড়তে আসি আল্লাহ এ যাত্রায় যেন বাঘের সামনে ফেলিও না।’
কিছুক্ষণ ঘোরার পরে মালঞ্চ রেস্ট হাউজের ফরেস্ট অফিসারের আতিথেয়তায় হালকা চা-নাশতা করে ফেরার জন্য বেড়িয়ে পড়লাম।
প্রায় দুই ঘণ্টা মালঞ্চ, কলাগাছিয়া, খোলপেটুয়া নদীর ওপর লঞ্চ ভ্রমণ শেষে আমরা যাত্রা শুরুর স্থানে নীলডুমুর খেয়াঘাটে এসে পৌঁছালাম।
এই নীলডুমুর ঘাটে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে পারেন স্পেশালভাবে। বিশেষ করে এখানে এমন কিছু মাছ পাওয়া যায় যেগুলো দেশের অন্য কোথাও দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে।
মাছগুলোও অনেক সুস্বাদু। খাবার হোটেলে রান্না করা যে মাছ পাবেন সেগুলা অথবা একটু সময় নিয়ে কিছু অতিরিক্ত টাকা যোগ করে নিজের ইচ্ছেমতো মাছ ফ্রাই, ভুনা করেও খেতে পারবেন।
চিংড়ি, আবাদি, সিলেট মাছ, ভেটকি, ভাঙান, পাসসে, টেংরা, কাইন, বাঁশপাতা, খয়রা, তপস্বে, দাঁতনে, ছোট মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির নদীর মাছ খাওয়ার সুযোগ তো থাকছেই।
তবে ভুল করে হরিণের মাংস খাওয়ার কথা মুখে না আনা ভালো। কারণ এটা নিষিদ্ধ।
আমরা দেওয়ান শাহাদত মামার খাবার হোটেলে গিয়ে দেখি মাছের সব আইটেম শেষ।
আগে থেকে খোঁজ নিয়ে এসেছিলাম দেওয়ান মামার রান্না এখানে সেরা।
মামা বলল, আধা ঘণ্টার ভিতরে রান্না করে খাওয়ার পরিবেশন করতে পারবে। আমরা সিলেট মাছ ভুনা অর্ডার করলাম।
হোটেল মালিক দেওয়ান শাহাদতের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় হওয়ার পর জানলাম তিনি এ অঞ্চল নিয়ে কিছু কবিতা লিখেছেন।
তার স্বরচিত চমৎকার সব কবিতা আমাদের পড়ে শোনালেন এবং এ কবিতার লেখার পেছনের কাহিনীগুলো বললেন।
কখন যে আধা ঘণ্টা চলে গেল বুঝলামই না।
স্মৃতির পাতায় সুন্দরবন ভ্রমণের অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা নিয়ে রাতে ফিরলাম রিসোর্টে।
আর মনের ভেতর অনুভব হতে লাগল, ‘আসলেই আমাদের মাতৃভূমি অনেক সুন্দর’। রিসোর্টের কালুর (কুকুর) কথাও বলতে হবে, সখ্য হয়েছিল প্রথম দিনেই।
কালু বলে ডাকলে যেখানেই থাক না কেন ছুটে আসত।
রাতে ঘুমিয়ে হাতে সময় থাকলে পরদিন আশপাশের গ্রামে বসবাসরত মৌয়াল, বাওয়াল ও মুন্ডা আদিবাসীদের জীবনযাত্রাটা দেখে নিতে পারেন।
এ ছাড়া চাইলে শ্যামনগরের ঐতিহাসিক প্রতœতাত্ত্বিক সব নিদর্শন (জমিদার বাড়ি, শাহী মসজিদ, যশোরেশ্বরী মন্দির, হাম্মামখানা, যীশুর গির্জা)গুলোও একবার দেখে আসতে পারেন।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি সাতক্ষীরা শহর বা শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের বাস আছে।
ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা আসতে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে, তবে ফেরিতে জ্যাম থাকলে সময় বেশি লাগবে।
গাবতলী, সায়েদাবাদ থেকে সোহাগ পরিবহণ, সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস, ঈগল পরিবহণ, একে ট্রাভেলস, মামুন পরিবহণসহ আরও কয়েকটি বাস সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
এ ছাড়া আকাশপথে আসতে চাইলে যশোর বিমানবন্দরে নেমে বাসযোগে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে।
সেখান থেকে বুড়িগোয়ালিনির নীলডুমুর ফরেস্ট অফিস থেকে পাস গ্রহণ করে ইঞ্জিনচালিত নৌকা অথবা লঞ্চ যোগে সুন্দরবনে ভ্রমণের সুযোগ থাকছে।
কোথায় থাকবেন
সাতক্ষীরা শহরে অনেক ভালোমানের রিসোর্ট আছে। তবে মুন্সিগঞ্জে থাকার জায়গা দুটিÑ সুশীলনের টাইগার পয়েন্ট ও বরসা রিসোর্ট।
সড়কপথে সুন্দরবন দেখতে হলে মুন্সিগঞ্জে আসতে হবে।
মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড নেমে ডান দিকের রাস্তা দিয়ে ৩-৪ মিনিট হাঁটলে মালঞ্চ নদীর তীর ঘেঁষে চোখে পড়বে সুশীলনের টাইগার পয়েন্ট এবং বাসস্ট্যান্ড থেকে বামপাশের রাস্তা দিয়ে কিছু দূর হেঁটে চুনা নদীর ব্রিজ পার হলে নদীর তীর ঘেঁষে বরসা রিসোর্টের দেখা মিলবে।
টাইগার পয়েন্টে রুমপ্রতি ভাড়া ১১৫০ টাকা থেকে শুরু। তবে বেড নিলে প্রতি বেডের ভাড়া পড়বে ৩০০ টাকা, এক রুমে ৪টি বেড।
বরসাতে রুমপ্রতি ভাড়া ১২০০ থেকে শুরু, এখানে বেড ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই।
তবে এ রিসোর্টটি একদম সুন্দরবনের ভিতরে।
সাতক্ষীরা দিয়ে সড়কপথে সুন্দরবনে ভ্রমণে আসতে পারেন আপনিও।
এ সড়কপথে সুন্দরবন দেখার সুবিধার জন্যই হয়তো সাতক্ষীরার ব্র্যান্ড নেম ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন’।
-আরএস মাহমুদ হাসান