শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত তিন দিনে আওয়ামী লীগ আমলের একাধিক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে একাধিক মামলা। এসব মামলার এজাহার ও আদালতে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত সরকারের সময় ঠিক যেভাবে মামলা, গ্রেপ্তার বা রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তার ব্যতিক্রম নেই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও।
এ ধরনের মামলায় প্রকৃত আসামিদের বিচার কতোটা সম্ভব আর আইনের ফাঁক দিয়ে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে কি-না, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বর্তমান প্রক্রিয়া দেখে আমার মনে হচ্ছে, তারা আগের সরকারের প্রক্রিয়া ফলো করছে। বরং যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তারা তাদের নিজস্ব প্রেসকিপশনে গ্রেপ্তার হচ্ছেন কি-না তা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে।”
গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ নেতারা এ ধরনের “গেইম খেলতে খেলতে অভ্যস্ত” বলে মনে করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, “যে মামলায় তারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, সেখানে তাদের যদি সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকে বা ইন্ধনদাতা হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা যাবে না। যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তাদের অপরাধ তো অন্য জায়গায়। সেটা যতটা না খুনের, তত বেশি দুর্নীতি, অর্থপাচারের। তারা তো বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পুরনো ঘটনা তো আছেই।”
আওয়ামী লীগের নেতারা নানা ধরনের ফৌজদারি অপরাধ করেছেন জানিয়ে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “সেই মামলাগুলো করা প্রয়োজন। আইনি ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ফেরানোটা জরুরি। আমার মনে হয়, সরকারের কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে একটা প্ল্যান অব অ্যাকশন পাওয়াটা জরুরি। সেটা এখনও আমরা পাইনি।”
সর্বশেষ শনিবার চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে কলেজছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী (১৯) হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও নগরের তিন কাউন্সিলরসহ প্রায় ৮০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা ও দুটি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। সবগুলোতে হত্যার অভিযোগ। এর মধ্যে বগুড়া ও চট্টগ্রামে মামলা হয়েছে থানায়। এছাড়া ঢাকার আদালতে চারটি মামলা করা হয়েছে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ জমা পড়েছে। সবগুলো মামলাতেই শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত শীর্ষ পর্যায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক তানভির হাসান সৈকত ও ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (সদ্য অবসরে পাঠানো) জিয়াউল আহসান। এর মধ্যে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জিয়াউল আহসানকে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে (২৪) হত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া পলক, টুকু ও সৈকতকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে পল্টন থানায় রিকশাচালক কামাল মিয়া (৩৯) হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে।
এই দুটি মামলার এজাহার ও আদালতে পাঠানো পুলিশের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলার কোথাও আসামিদের নাম নেই। সন্দেহভাজন নির্দেশদাতা হিসেবে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গত ১৬ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশের দোকানের কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়েশা বেগম (৪৫) একটি মামলা করেন। মামলায় সব আসামি করা হয় অজ্ঞাতপরিচয়।
মামলার অভিযোগে আয়েশা বেগম উল্লেখ করেছেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি তার ছেলের মোবাইল থেকে ফোন করে জানায়, শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ধানমণ্ডি পপুলার হাসপাতালে ভর্তি। সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক পপুলার হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, তার ছেলেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে মর্গ থেকে ছেলের মরদেহ শনাক্ত করেন তিনি। অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা তার ছেলের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি আঘাত করেছে। ফলে তার ছেলে রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলেন।
গত ২০ জুলাই পল্টন এলাকায় রিকশাচালক কামাল মিয়া হত্যা ঘটনায় তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৩৬) বাদি হয়ে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোনে তিনি জানতে পারেন তার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন। তাকে উদ্ধার করে পথচারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই মামলাতেও কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন অর্থাৎ ৬ আগস্ট এয়ারপোর্ট থেকে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তখন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, তাকে একটি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ ১৪ আগস্ট তাকে নিকুঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। আগের সরকারের সময়ও একই ধরনের অভিযোগ ছিল যে, এক জায়গা থেকে ধরে নিয়ে অন্য জায়গা থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হতো।
অপরদিকে অভিযুক্তদের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি তাদের আদালতে নেওয়ার সময় অন্য আইনজীবীরা ডিম নিক্ষেপ করেছেন। আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। যারা দাঁড়াতে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে কয়েকজন আইনজীবী দুর্ব্যবহার করেছেন। সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হকের রিমান্ড আবেদন শুনানিতে আইনজীবীরা কথা বলতে না পারলেও শামসুল হক টুকু, জুনাইদ আহমেদ পলক ও তানভীর হাসান সৈকতের ক্ষেত্রে একজন আইনজীবী সংক্ষিপ্ত শুনানি করেছেন।
এদিন আদালত প্রাঙ্গণ ও এজলাসের ভেতরে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আসামিদের ফাঁসি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। আসামিদের পক্ষে আইনজীবী আতাউর রহমান শুনানি করতে চাইলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ওকালতনামা দেওয়া যাবে না বলে চিৎকার করতে থাকেন। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের চাপের মুখে সংক্ষিপ্ত শুনানি করেন আতাউর রহমান। তিনি বলেন, “আমি এই তিনজনের পক্ষে ওকালতনামা জমা দিলাম। আমি তাদের জামিন চাই।”
বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হট্টগোল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষ হওয়ার মিনিট দশেক পর আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে মহানগর হাকিম রশিদুল আলম এজলাস ছেড়ে খাসকামরায় চলে যান।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ডেভিড বার্গম্যান এক্স হ্যান্ডেলে নিজের দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, “এটি অত্যন্ত ভয়ানক। ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে বিচারকার্য চালিয়ে গেলেন? এ ধরনের মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলাগুলো অব্যাহত থাকবে যদি না পুলিশ ও আদালতকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয় যে তাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা হয়। সেই প্রত্যাশা হলো আইনের ন্যায্য প্রয়োগের পাশাপাশি পেশাদারিত্বের একটি স্তর প্রদর্শন করা, যা এখন এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না।”
এখনও যদি অভিযুক্তের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়াতে দেওয়া না হয় তাহলে পরিস্থিতির কী পরিবর্তন হলো? জানতে চাইলে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “মানুষ চায় পরিস্থিতির বদল হোক। বৈষম্যবিরোধী পরিস্থিতির জন্যই তো ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল। তাদেরও কিন্তু নিশ্চিত করা দরকার যে, কারও প্রতি বৈষম্য না হয়। আগের সরকারের সময় তো দেখেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তারপরও আইনজীবীদের বাধা দেওয়া হয়নি। তাদের পক্ষে আইনজীবীরা কথা বলেছেন।”
অপরাধী যে-ই হোক তার পক্ষে তো আইনজীবীকে কথা বলতে দিতে হবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, “কথা বলতে না দিলে তো বৈষম্যই থেকে গেল। পরিস্থিতির তো বদল হলো না। এমন চলতে থাকলে মানুষের প্রত্যাশার ওপর চিড় ধরবে। তারা হতাশ হবেন। তারা মনে করবেন, কিছুই হবে না। শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন মাত্র।”
এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বাকের মজুমদার বলেন, “আমরা আসলে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছি। এখনও এদিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে আমরা শিগগিরই এই বিষয়গুলো দেখব। সত্যিকারে যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরে আনব। যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হন। অবশ্যই প্রত্যেকের আইনজীবী পাওয়ার অধিকার আছে।”
আওয়ামী লীগের ভুল থেকে কি বিএনপি কোনো শিক্ষা নিয়েছে কি-না জানতে চাওয়া হয় দলটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের কাছে। তিনি বলেন, “অবশ্যই আগে যেটা হয়েছে, এখন সেটা হবে না।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী নিয়োগে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যাদের আদালতে নেওয়া হয়েছে, তারা গণধিকৃত ব্যক্তি। ফলে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক আক্রোশ হয়তো তাদের বিরুদ্ধে ছিল। আর এখনও তো আদালতের পিপি, এপিপিসহ সবাই আগের সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া। তবে আমরা নিশ্চিত করব, ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি আর না হয়।”