ঢাকা ০২:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলোচিত সাত খুনের দশ বছর: সাজা কার্যকরের অপেক্ষায় স্বজনেরা

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের ঘটনার দশ বছর আজ। নিম্ন আদালতে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। আপিল করলে উচ্চ আদালতেও হয় নিষ্পত্তি। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। তবে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির শুনানি বন্ধ থাকায় এখনও কার্যকর হয়নি দণ্ড। এতে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির শুনানি হচ্ছে না বলে অভিযোগ বাদীপক্ষের আইনজীবীর।

দশ বছর বয়সের শিশু রোজা মনি মায়ের গর্ভে থাকতেই তার বাবার মৃত্যু হয় নৃশংস সাত খুনের ঘটনায়। বাবাকে দেখতে না পেলেও ফ্রেমে বাঁধানো বাবার ছবিটিকে আঁকড়ে ধরেই দশটি বছর পার করলো এ শিশু। আর অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন মা নূপুর।

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের মেয়ে রোজা বলে, ‘আমার জন্মের পর বাবাকে দেখিনি। বাবার আদর-ভালোবাসা পাইনি। আমার জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি।’

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূপুর বলেন, ‘আমার বাচ্চা প্রতিরাতে কান্না করে। ওর চাচারা তাদের ছেলে মেয়েকে কত আদর করে। অথচ আমার মেয়েকে কেউ একটু আদর করে না। আমার মেয়ে বাবার আদর কেমন সেটা জানে না।’

একইভাবে নানা দুঃখ-দুর্দশা ও ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে দীর্ঘ দশ বছর পার করছেন নিহত অন্য ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিচার এখনও কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

নিহতদের স্বজনরা বলছেন, সরকার যদি বিচারটা করতো, সেটা দেখে মরতে পারলেও কিছুটা শান্তি পেতাম। আমার ছেলে হত্যার বিচারটা হয়েছে। আমরা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি, আসলে কি তাদের বিচার হবে!

মামলার বাদী ও নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী বলেন, ‘আসলে এখন আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই। আমরা শুধু বিচারটুকু চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ তিনি যাতে সন্তান হারানো মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বিচারটা করেন।’

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুইগড় এলাকা থেকে একসঙ্গে অপহৃত হন সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার তিন বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, জেলা আদালতের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম।

পরে ৩০ এপ্রিল থেকে পহেলা মে পর্যন্ত একে একে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে অপহৃত সাতজনের মরদেহ। ওই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে আলাদা দুটি হত্যা মামলা করেন। পরে দুই মামলায় ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।

আলোচিত এই হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‍্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ হোসেন, চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত।

পরে ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট উচ্চ আদালত ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৯ সালে র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন, এম মাসুদ রানা, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা নূর হোসেনসহ দণ্ডিত আসামিরা আলাদাভাবে আপিল করেন।

তবে আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির শুনানি এখনও হচ্ছে না বলে অভিযোগ বাদীপক্ষের আইনজীবীর।

বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াৎ হোসেন খান বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের যাতে বিচার না হয়, সে চেষ্টা কিন্তু হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আপিলিয়েট ডিভিশনে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা চাই, যে রায় হয়েছে সেটি দ্রুত কার্যকর করা হোক।

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ২৩ জন আসামি কারাগারে এবং ১২ জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন।

আলোচিত সাত খুনের দশ বছর: সাজা কার্যকরের অপেক্ষায় স্বজনেরা

আপডেট সময় : ১২:২৬:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের ঘটনার দশ বছর আজ। নিম্ন আদালতে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। আপিল করলে উচ্চ আদালতেও হয় নিষ্পত্তি। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। তবে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির শুনানি বন্ধ থাকায় এখনও কার্যকর হয়নি দণ্ড। এতে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির শুনানি হচ্ছে না বলে অভিযোগ বাদীপক্ষের আইনজীবীর।

দশ বছর বয়সের শিশু রোজা মনি মায়ের গর্ভে থাকতেই তার বাবার মৃত্যু হয় নৃশংস সাত খুনের ঘটনায়। বাবাকে দেখতে না পেলেও ফ্রেমে বাঁধানো বাবার ছবিটিকে আঁকড়ে ধরেই দশটি বছর পার করলো এ শিশু। আর অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন মা নূপুর।

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের মেয়ে রোজা বলে, ‘আমার জন্মের পর বাবাকে দেখিনি। বাবার আদর-ভালোবাসা পাইনি। আমার জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি।’

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূপুর বলেন, ‘আমার বাচ্চা প্রতিরাতে কান্না করে। ওর চাচারা তাদের ছেলে মেয়েকে কত আদর করে। অথচ আমার মেয়েকে কেউ একটু আদর করে না। আমার মেয়ে বাবার আদর কেমন সেটা জানে না।’

একইভাবে নানা দুঃখ-দুর্দশা ও ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে দীর্ঘ দশ বছর পার করছেন নিহত অন্য ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিচার এখনও কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

নিহতদের স্বজনরা বলছেন, সরকার যদি বিচারটা করতো, সেটা দেখে মরতে পারলেও কিছুটা শান্তি পেতাম। আমার ছেলে হত্যার বিচারটা হয়েছে। আমরা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি, আসলে কি তাদের বিচার হবে!

মামলার বাদী ও নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী বলেন, ‘আসলে এখন আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই। আমরা শুধু বিচারটুকু চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ তিনি যাতে সন্তান হারানো মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বিচারটা করেন।’

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুইগড় এলাকা থেকে একসঙ্গে অপহৃত হন সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার তিন বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, জেলা আদালতের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম।

পরে ৩০ এপ্রিল থেকে পহেলা মে পর্যন্ত একে একে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে অপহৃত সাতজনের মরদেহ। ওই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে আলাদা দুটি হত্যা মামলা করেন। পরে দুই মামলায় ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।

আলোচিত এই হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‍্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ হোসেন, চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত।

পরে ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট উচ্চ আদালত ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৯ সালে র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন, এম মাসুদ রানা, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা নূর হোসেনসহ দণ্ডিত আসামিরা আলাদাভাবে আপিল করেন।

তবে আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির শুনানি এখনও হচ্ছে না বলে অভিযোগ বাদীপক্ষের আইনজীবীর।

বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াৎ হোসেন খান বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের যাতে বিচার না হয়, সে চেষ্টা কিন্তু হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আপিলিয়েট ডিভিশনে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা চাই, যে রায় হয়েছে সেটি দ্রুত কার্যকর করা হোক।

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ২৩ জন আসামি কারাগারে এবং ১২ জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন।